মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে বেশ কমাস। পুরোদমে উৎপাদনে আসতে আরও সময় লাগবে।
ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে এলাকার মানুষকে ভিটেছাড়া হতে হয়েছে, অবশ্য তারা সরকারি ক্ষতিপুরণও পেয়েছে। এরপরও মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া এবং পুরো কক্সবাজারের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ মিলবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পুরো উল্টো।
কেন্দ্রটি থেকে বৃহস্পতিবার উৎপাদিত হয়েছে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। প্রায় প্রতিদিনই এই পরিমাণ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। কিন্তু এই বিদ্যুৎ পাচ্ছে না মহেশখালী, চকরিয়া ও পেকুয়ার মানুষ। নিজ এলাকায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি চলে যাচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। দুর্বিসহ লোডশেডিংয়ে ভুগলেও নিজ এলাকায় উৎপাদিত বিদ্যুতের নাগাল পাচ্ছে না কক্সবাজার জেলাবাসী। চট্টগ্রামেও তা যাচ্ছে না, তবে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ। কিন্তু কেন?
বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকারের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড- বিপিডিবি (পিডিবি নামে পরিচিত)। তাদের কাছ থেকে কিনে গ্রাম এলাকার গ্রাহকদের সরবরাহ দেয় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (পল্লী বিদ্যুৎ)। ফলে সেখানে বৈষম্য করে পিডিবি। পিডিবি নিজেদের জন্য বেশি রেখে বাকিটা পল্লীবিদ্যুতকে দেয়। এতে সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়ে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা, যারা গ্রামে থাকে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকা মাতারবাড়ীর পাশের উপজেলা চকরিয়ায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক ৯০ হাজার। পিক আওয়ারে চাহিদা থাকে ১৮ মেগাওয়াট, আর অফপিকে চাহিদা থাকে ১৫ মেগাওয়াট। বিপরীতে সরবাহ পাচ্ছে যথাক্রমে ৭ ও ৫ মেগাওয়াট।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চকরিয়া পল্লী বিদ্যুতের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সাদিকুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা এখন মাতারবাড়ী সাব স্টেশন গ্রিড থেকেই বিদ্যুৎ পাচ্ছি। আগে কক্সবাজার দোহাজারী থেকে পেতাম।
“এখন আমার এলাকায় ১১টি ফিডার লাইনে ৫ মেগাওয়াট সরবরাহ দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। একদিকে রমজান আবার সেচ মৌসুমের কথা চিন্তা করতে হচ্ছে। ফলে গ্রাহকদের গালাগাল খেতে হচ্ছে। আমি তো চাহিদামতো বিদ্যুৎ পাচ্ছি না।”
মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছে কেন
বিদ্যুত বিতরণ কর্তৃপক্ষ বলছে, মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ চট্টগ্রামের মদুনাঘাট পর্যন্ত না নিয়ে সরাসরি নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে নেওয়া হচ্ছে। মদুনাঘাট হচ্ছে চট্টগ্রামের বিদ্যুতের গ্রিড উপকেন্দ্র। যেখান থেকে চট্টগ্রাম জেলা, কক্সবাজার জেলা, তিন পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হয়। মেঘনাঘাটে নেওয়ার কারণ হচ্ছে, মাতারবাড়ী থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত নতুন সঞ্চালন লাইন নির্মাণ পুরোপুরি শেষ হয়নি। ফলে মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম বাদ দিয়ে আরেকটি সঞ্চালন লাইনে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয়েছে একেবারে সাড়ে তিনশ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে। আর বিদ্যুৎ না পেয়ে ফুঁসছে এলাকাবাসী।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তাপস কুমার ভৌমিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মাতারবাড়ী থেকে এখন একটি সঞ্চালন লাইন প্রথমে বাঁশখালী এস এস পাওয়ারে এসেছে। সেখান থেকে একটি লাইন সরাসরি মেঘনাঘাটে চলে গেছে। আরেকটি লাইন চট্টগ্রামের মদুনাঘাটে চলে গেছে। মেঘনাঘাট ও মদুনাঘাটে দুটি লাইন চালু হবে। একইসঙ্গে মদুনঘাটে সাব স্টেশন চালু হলেই পুরোদমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সক্ষমতা তৈরি হবে।”
বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল অবশ্য ভিন্নভাবে বিষয়টি দেখছেন। তিনি বলেন, “উৎপাদিত সব বিদ্যুতই প্রথমে জাতীয় গ্রিডে যায়। এরপর কেন্দ্রীয়ভাবে সেটি বিতরণ হয়। এখন চট্টগ্রামে বেশি উৎপাদন হলেই বেশি পাবে এমনটা ভাবার কারণ নেই।
“কেন্দ্র থেকে যে যত পায় বাকিটা লোডশেড করে। যেমন বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে ২০০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট লোডশেড দিতে হয়েছে। চট্টগ্রামে মোট চাহিদা থাকে ১৪০০ মেগাওয়াটের বেশি। যেমন আজকে শুক্রবার চাহিদা কমার যেটার ধারণা করেছিলাম, সেটি কিন্তু হয়নি। ফলে লোডশেড করতে হচ্ছে।”
মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ চট্টগ্রামে সরবরাহ কবে
মহেশখালীর মাতারবাড়ী থেকে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট পর্যন্ত ৪০০ কেভি লাইন নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে ২০১৯ সালে। ৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য ৭৯৫ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এই সঞ্চালন লাইন দিয়ে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত সরবরাহের জন্য তৈরি হচ্ছে।
চুক্তির ৩০ মাস অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে নির্মাণ শেষের কথা থাকলেও ২০২৪ সালে সেই সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষ করতে পারেনি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কেইসি ইন্টারন্যাশনাল।
এরই মধ্যে মহেশখালীর কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শেষ করে উৎপাদনে চলে এসেছে, কিন্তু সঞ্চালন লাইন পুরোপুরি চালু হয়নি। ফলে উৎপাদন করে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না পুরো কক্সবাজারবাসী।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তাপস কুমার ভৌমিক বলেন, “সঞ্চালন লাইন পুরোপুরি নির্মাণ শেষ হয়েছে, আর মদুনাঘাটে সাব স্টেশনের এখন ট্রায়াল রান চলছে। মে মাস নাগাদ সেই স্টেশন চালু হলে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের পুরোটাই চট্টগ্রামে দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি হবে। আর সঞ্চালন লাইন চালু হচ্ছে বিধায় আমরা আগে থেকেই একটি বিকল্প ব্যবস্থা রেখেছি। যে মাধ্যমে এখন বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে।”
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তাপস কুমার ভৌমিক বলেন, “চকরিয়াতে এখন বিদ্যুৎ আসে তিনটি স্টেশন থেকে। দোহাজারী স্টেশন, কক্সবাজার স্টেশন এবং মহেশখালীর মাতারবাড়ীর সাব স্টেশন থেকে। আমরা চকরিয়াতে পৃথক একটি গ্রিড স্টেশন নির্মাণ করছি। মাটি ভরাট শেষ হয়েছে, জুন ২০২৫ নাগাদ সেই স্টেশন চালু হবে। তখন চকরিয়া সরাসরি বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। একইসঙ্গে টেকনাফে একটি পৃথক গ্রিড স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হবে। সুত্র: সকালসন্ধা
পাঠকের মতামত